মুক্তিযুদ্ধের বই@ ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সরঞ্জাম পাঠান প্রবাসীরা
লিখেছেন লিখেছেন ক্যাকটাস হিমু ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৪, ১১:৩২:১৭ সকাল
আবু সাঈদ চৌধুরী
বিজয়ের মাসে প্রথম আলোর এই ধারাবাহিক আয়োজনের বিষয় দেশি-বিদেশি লেখকদের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই। আজকের বই আবু সাঈদ চৌধুরীর প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী (পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপতি)। সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে তিনি বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতা ছিলেন। বইটিতে মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালিদের অবদানের কথা বিবৃত হয়েছে।
২৩ সেপ্টেম্বর অপরাহ্ণে নিউইয়র্ক বিমানবন্দরে পৌঁছে দেখি এ এইচ মাহমুদ আলী (বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী) আগের মতো অনেককে নিয়ে
এবারও উপস্থিত।...নিউইয়র্কে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কর্মপদ্ধতি ও কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা শুরু হলো। ওয়াশিংটন থেকে এলেন আমেরিকায় আমাদের নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত মুস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী (এম আর সিদ্দিকী) এবং ওয়াশিংটন দূতাবাসের কয়েকজন সদস্য।
তা ছাড়া ব্যক্তিগতভাবে ২৬ মার্চ থেকেই যাঁরা কাজ শুরু করেছিলেন তাঁরাও নানা বিষয়ে আলোচনার জন্য এলেন। আমেরিকাস্থ ইস্ট
পাকিস্তান লিগের সভাপতি কাজী শামসুদ্দিন আহমদ তাঁর অন্যান্য সহকর্মী সহযোগে এলেন। ...
কাজী শামসুদ্দিনের কাছ থেকে অত্যন্ত উৎসাহোদ্দীপক কর্মবিবরণী পেলাম। ঠিক হলো, আমরা কূটনৈতিক প্রচারকার্য চালাব আর ইস্ট পাকিস্তান লিগ জনমনে উত্তরোত্তর সমর্থন বৃদ্ধি করার জন্য শোভাযাত্রা, সভা ইত্যাদি আয়োজন করতে থাকবে। ওয়াশিংটনে এ এম এ মুহিত (বর্তমান অর্থমন্ত্রী) ও হারুন-অর-রশিদ (কূটনীতিক) এপ্রিল মাস থেকেই ব্যক্তিগত পর্যায়ে কাজ শুরু করেছিলেন। ৪ আগস্ট ওয়াশিংটনসহ পাকিস্তানি দূতাবাসের সব বাঙালি সদস্য সম্পর্ক ছিন্ন করলে আমাদের ওয়াশিংটনস্থ সংগঠন পূর্ণতা লাভ করে। আমার মে মাসের সফরের সময় নিউইয়র্কে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে নানাভাবে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন মাহবুব হোসেন ও ফররুকুল ইসলাম। এবারও বিমানবন্দরে পৌঁছেই তাঁদের দেখতে পেয়ে খুবই আনন্দিত হলাম।
কাজী রেজাউল হাসান দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ অত্যন্ত উৎসাহী যুবক। তিনি গতবারেই আমার নিউইয়র্কের সভায় যোগদান করেন এবং স্বাধীনতা আন্দোলনে সকল প্রকার সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। আমি তাঁকে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাঠানোর জন্য চেষ্টা করতে বলেছিলাম। এবার এসে তাঁর কাছ থেকে যা শুনলাম তাতে অত্যন্ত উৎসাহিত বোধ করলাম। মাহবুব হোসেন তখন যান্ত্রিক প্রকৌশল বিভাগের ছাত্র ছিলেন। ফররুকুল ইসলাম তখন ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ করতেন। তাঁরা সব কাজ ফেলে দিয়ে আমার সঙ্গে নানা জায়গায় যেতেন। নিউইয়র্কে পাকিস্তানের কনসাল জেনারেলের অফিস দখল করার ব্যাপারে তাঁদের অগ্রণী ভূমিকা ছিল। রেজাউল হাসান বোস্টনে থাকলেও আমাকে জানান যে তিনি এবং বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ কে মহিউদ্দীন আলমগীর নিউইয়র্কে এসে বাঙালিদের সঙ্গে সহযোগিতায় কাজ করতে পারেন। এপ্রিল মাস থেকে আন্দোলনে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন আবু নাসের চৌধুরী। আমেরিকার জীবনের নানা ক্ষেত্রে কর্মরত বাঙালিরা ২৬ মার্চের পরেই ত্বরিত বেগে আন্দোলনে যোগদান করেন।
এভাবেই যোগ দিয়েছিলেন প্রকৌশলী আনোয়ারুল হক তালুকদার, যেমন দিয়েছিলেন অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূস (গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠা)। কে এম আলমগীরের স্ত্রী রোকেয়া আলমগীরের কর্মনৈপুণ্যের প্রশংসা আমি অনেকের কাছেই শুনেছি। শামসুল বারী ও ফায়জুর রহমানের অবদানও খুব উল্লেখযোগ্য। তা ছাড়া বাংলাদেশ লিগ অব আমেরিকার জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে চক্ষু চিকিৎসক এম আহমেদের পরিশ্রম ও সাধনার কথা সবাই জানেন। কাজী রেজাউল হাসান এবং তাঁর ভাই কাজী শহীদুল হাসান সারাক্ষণ কাজ করে যাচ্ছিলেন। ছাত্রনেতা এ কে এম হোসেন, আবদুল মান্নান এবং শিকাগোর মোজাম্মেল হক, শহীদুল আলমও অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। খোরশেদ আলম, মাহবুবুল আলম মে মাসেও আমার সঙ্গে দেখা করে আন্দোলনের পক্ষে কাজ শুরু করার কথা জানান। এবার এসে দেখলাম, তাঁরা সংঘবদ্ধ হয়েছেন এবং সুসংহতভাবে আন্দোলনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। খোরশেদ আলম বৃহত্তর বোস্টনের বাংলাদেশ সংগ্রাম পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি আন্দোলনের আগে সিএসপি অফিসার ছিলেন। এই আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন রেজাউল করিম ভূঁইয়া। তিনি পরবর্তীকালে ওয়াপদার চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। আমিনুল ইসলামও একজন প্রকৌশলী। তিনি সংগ্রাম পরিষদে বিশিষ্ট ভূমিকা রেখেছেন। ছাত্রনেতা মবিন উদ্দীনের প্রশংসাও আমি অনেকের কাছে শুনতে পাই। বাংলাদেশ লিগ অব আমেরিকা শিখা নামে একটি সাপ্তাহিক নিউজ বুলেটিন বের করে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ও এমআইটিতে অর্থাৎ ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে অনেক বাঙালি ছিলেন। ২৬ মার্চে তাঁরা ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতার কথা জানতে পারার সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় কর্মপন্থা গ্রহণের জন্য চঞ্চল হয়ে ওঠেন। তাঁরা প্রতিদিন হার্ভার্ড পপুলেশন স্টোরে মিলিত হতে থাকেন। মাহবুবুল আলম, তৈয়বুদ্দীন মাহতাব ও খোরশেদ আলম অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে নানা দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসেন। তাঁরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে অধ্যবসায় এবং একাগ্রতার দ্বারা আমাদের সংগ্রামের জন্য সমর্থন অর্জন করেছেন। আমি মে মাসে তড়িৎ প্রকৌশলী রেজাউল হাসানকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যোগাযোগের যন্ত্র পাঠানোর জন্য সক্রিয় প্রচেষ্টা চালাতে অনুরোধ করেছিলাম। এবার এসে যোগাযোগ যন্ত্র পাঠানোর ব্যাপারে অভাবিত সাফল্যের কথা শুনে নিবিড় আনন্দ পেলাম। ২৪ মের আগেই হারুন-অর-রশিদ মুজিবনগরে গিয়ে নেতাদের সঙ্গে দেখা করে এসেছিলেন। রেজাউল হাসান তাঁর কাছ থেকে যোগাযোগ যন্ত্রের প্রয়োজন সম্পর্কে বেশ কিছুটা ধারণা লাভ করেছিলেন।
এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দুটি আইন আছে। সেগুলোকে এড়িয়ে রেজাউল হাসানকে যন্ত্রাদি পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। এই আইন দুটির ফলে কোনো বিদেশি লোকের পক্ষে কোথাও সংগ্রামে লিপ্ত অবস্থায় ত্রাণদ্রব্যাদিও পাঠানো যায় না। এ অবস্থা আমি রেজাউল হাসানের কাছ থেকে শুনে বাস্তবিকই অভিভূত হয়েছিলাম যে নিউ হ্যাম্পশায়ার স্টেটের কনকর্ডে ফ্রাঙ্কলিন পিয়ার্স লসেন আরের অধ্যক্ষ (ডিন) ড. রবার্ট রাইস এ বিষয়ে সব ধরনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি একাডেমি অব অ্যাপ্লাইড সায়েন্সেরও প্রেসিডেন্ট। এই প্রতিষ্ঠানটিও নিউ হ্যাম্পশায়ার স্টেটের রাজধানী কনকর্ডে অবস্থিত। তিনি এই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ত্রাণকার্যে সহায়তার জন্য এসব যন্ত্রপাতি পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। পাঠানো যন্ত্রের মধ্যে ছিল ১০টি এইচএম কমিউনিকেশন সেট, ৫০টি পাঁচ ওয়াট পোর্টেবল ওয়াকিটকি টাইপ রেডিও টেলিফোন সেট, ৪৫টি ১৫ ওয়াট পোর্টেবল রেডিও টেলিফোন সেট, তিন হাজার ৫০৪টি ব্যাটারি সেলস, ১৫টি ব্যাটারি চার্জার, আটটি ইলেকট্রনিকস টেস্ট ইকুইপমেন্ট অ্যান্ড মিটার। এসব জিনিসের তৎকালীন মূল্য ছিল ৮২ হাজার ৯৫০ ডলার।
এ সম্পর্কে মুজিবনগর সরকারের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানী রেজাউল হাসানকে যে চিঠি লেখেন তা দেখে আমি আনন্দ ও স্বস্তিবোধ করলাম। সেই চিঠিতে এসব জিনিসপত্রের জন্য তিনিও আনন্দ প্রকাশ করেছেন এবং লিখেছেন যে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা নানা রকম অসুবিধার মধ্যে থেকেও নানাভাবে সাফল্য অর্জন করছেন। তিনি আরও লেখেন যে আমাদের যদি একটি প্রাণহানি হয়, শত্রুর হয় ৪০টি। এই চিঠি তিনি সেপ্টেম্বর মাসে মুজিবনগর থেকে লিখেছিলেন এবং তিনি আরও কিছু যন্ত্রপাতির একটি তালিকা পাঠিয়েছিলেন। রেজাউল হাসান সেগুলোও পাঠানোর ব্যবস্থা করছিলেন, এমন সময় ২৩ সেপ্টেম্বর আমি নিউইয়র্ক পৌঁছালাম।
কাজী রেজাউল হাসানের কাছ থেকে আমি জানতে পারি যে যন্ত্রাদির জন্য মোট খরচ ৮২ হাজার ৯৫০ ডলারের মধ্যে ১৮ হাজার ৩১৪ ডলার কয়েকজন বাঙালি মিলে দিয়েছেন। যন্ত্রাদির মধ্যে এইচ এফ কমিউনিকেশন সেট পাঠানো হয় ১০টি। এগুলোতে ১০ হাজার মাইল দূরেও কথা বলা যায় এবং মরস কাভে সংবাদ দেওয়া-আনা করা চলে। পাঁচ ওয়াট ভিএইচএফ ওয়াকিটকি সেটে পাঁচ মাইলের মধ্যে খবর দেওয়া নেওয়া চলে। এগুলো পাঠানো হয় ৫০টি। তা ছাড়া ৪৫টি দেড় ওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ওয়াকিটকি পাঠানো হয়েছে। এগুলো দুই মাইলের মধ্যে অনুরূপ কাজে লাগে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বাধীন বাংলাদেশেও যোগাযোগের কাজ এগুলো দিয়েই শুরু হয়। যুদ্ধের সময় আমাদের মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা এগুলো গ্রামে-গঞ্জে, পাহাড়ে-জঙ্গলে ব্যবহার করেছেন।
প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি। আবু সাঈদ চৌধুরী। প্রকাশক ইউপিএল, ১৯৯০।
বিষয়: বিবিধ
৯৪৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য






































পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন